ঐতিহ্যবাহী ঘাটু গান: সঞ্জয় সরকার
'ঘাটু গান'। বাংলাদেশের চিয়ায়ত এক সঙ্গীত ধারা। এক সময় নেত্রকোনার গ্রামে-গঞ্জে এই গানের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। নেত্রকোনা ছাড়াও পূর্ব ময়মনসিংহ এবং বৃহত্তর সিলেটের গোটা হাওড়াঞ্চলই ছিল এ গানের আবাসভূমি। এসব এলাকায় স্থানীয় সমঝদার এবং উৎসুক গ্রামবাসীর পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ ঘটা করেই ঘাটু গান পরিবেশিত হতো। বিরাট জনপ্রিয়তার কারণে বিভিন্ন গ্রামে প্রতিযোগিতামূলকভাবে গঠন করা হতো ঘাটু গানের দল। বিশ শতকের প্রথমভাগেও অব্যাহত ছিল ঐতিহ্যময় সেই ধারাটি। কিন্তু বলা বাহুল্য, গৌরবময় লোকসঙ্গীতের অন্যান্য আঙ্গিকের মতো ঘাটু গানও এখন এ অঞ্চলের একটি বিলুপ্ত প্রকরণ।
এখানে উলেস্নখ্য, 'ঘাটু গান'-এর উচ্চারণ নিয়ে অঞ্চলভেদে ভিন্নতা রয়েছে। কোথাও কোথাও শব্দটিকে ঘাঁটু, ঘেটু, ঘেঁটু, গেন্টু, ঘাডু, গাড়ু, গাঁটু বা গাডু বলা হয়। তবে নেত্রকোনা অঞ্চলে এটি 'ঘাটু' এবং 'গাডু' নামেই বহুল প্রচলিত। একটু শিক্ষিত জনরা 'ঘাটু গান' বলেন। আবার স্বশিক্ষিত, সাধারণ জনগণ আঞ্চলিক শব্দে বলেন 'গাডু গান'। এর একটি কারণ_ এ অঞ্চলে 'ট' এর পরিবর্তে অনেকে 'ড' উচ্চারণ করেন। যেমন: মাটি>মাডি, ঘাট>ঘাড্। তেমনি 'ঘাটু' থেকে এসেছে 'গাডু' শব্দটি।
'ঘাটু গান' এর নামকরণের ইতিহাসও একেক জনের বর্ণনায় একেক রকম। সাধারণের ধারণা, ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে গাওয়া হতো বলে এর নাম হয়েছে ঘাটু গান। নেত্রকোনার স্থানীয় লোক সাহিত্য সংগ্রাহক গোলাম এরশাদুর রহমান তাঁর 'নেত্রকোনার লোকগীতি পরিচয়' গ্রন্থে উলেস্নখ করেন :
''ঘাটু নামকরণ সম্পর্কে স্থানীয়ভাবে আদিকালের সমঝদারদের বক্তব্য ছিল- কৃষ্ণের বাঁশির ঘাট শব্দ থেকে ঘাটু নামকরণ হয়। কারণ ঘাটু ছেলেটিকে মূলত নাচে ও গানে নিয়ন্ত্রণ করে বাঁশি''।
তবে এ সম্পর্কে সিরাজুদ্দিন কাশিমপুরীর মতামতকেই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন অনেকে। যতীন সরকার রচিত 'সিরাজুদ্দিন কাশিমপুরী' জীবনী গ্রন্থে আমরা জানতে পারি:
''.....'গাড়ু গান' বা 'গাঁটু গান' সম্পর্কে তিনি রীতিমতো মৌলিক সিদ্ধানত্মে উপনীত হতে পেরেছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে, 'গাঁড়' শব্দটির অঞ্চলভেদে উচ্চারণ ভেদ ঘঠেছে। যেমন- গাঁড়ু, গাড়ু, ঘাটু, ঘাঁটু, ঘেটু, গাঁটু ইত্যাদি। পশ্চিমা কুলিদের মুখে শব্দটির উচ্চারণ 'গাণ্টু'। শব্দটির আঞ্চলিক উচ্চারণভেদ পর্যালোচনা করে তিনি ধারণা করে নিয়েছেন-''এই শব্দের মূল অনুসন্ধান করিলে আমরা দুইটি শব্দ পাই- 'গান' আর 'ঘাট'। গান+টু=গাণ্টু>গাঁটু, আর ঘাট+উ=ঘাটু''। দু'টো শব্দের আনুপূর্বিক আলোচনার শেষে তিনি 'গাটু' শব্দটিকেই গ্রহণীয় বলে বিবেচনা করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি গোবর্ধন শাস্ত্রী নামক একজন গুজরাটী সন্ন্যাসীর সাক্ষ্য হাজির করেছেন। তার সঙ্গে আলাপ করে কাশিমপুরী জানতে পানঃ ক ''গুজরাটের নিম্নশ্রেণীর লোকেরা সুন্দর বালকদিগকে নাচগান শিখাইয়া মেয়েদের পোশাক ও অলঙ্কার পরাইয়া নৃত্যগীতের সঙ্গে বেশ আনন্দ উপভোগ করিয়া থাকেন। এই ছেলেদিগকে 'গাণ্টু' বলা হয়। খ ''বৃন্দাবন মথুরা হইতে গঙ্গার তীর ধরিয়া রাজমহল পর্যনত্ম নিম্ন শ্রেণীর চাষী ও কুলিদের মধ্যে 'গাণ্টু' গানের প্রচলন দেখা যায়''। এই সন্ন্যাসীর নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কাশিমপুরী 'গাণ্টু' গানের সঙ্গে 'গাড়ু' গানের একটা সম্পর্ক-সূত্র খুঁজে বের করেন। যে সূত্র ধরে অগ্রসর হয়ে নির্দ্বিধায় এই সিদ্ধানত্মে উপনীত হন যে; গাণ্টু থেকেই 'গাঁটু' ও 'গাড়ু' শব্দের উৎপত্তি। ্ত-কাশিমপুরী লিখেন- ''যাহারা শব্দটিকে 'ঘাটু' বলিতে চাহেন, তাঁহাদের সঙ্গে নানা কারণে একমত হওয়া চলে না। প্রথমত শ্রাবণী বর্ত আর শারদীয় পূজার আড়ং ব্যতীত এই ছেলের দলকে আর কোনদিন নৌকায় তুলিয়া 'ঘাটে ঘাটে' নৃত্যগীতের আসর জমাইতে দেখি নাই। এই দুইদিন ব্যতীত আর সব সময় এ গান লোকালয়েই গীত হইয়াছে। ...... দ্বিতীয়ত, কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, কৃষ্ণের যমুনার ঘাটে বিসখা গোপবালাদের সঙ্গে জলকেলি, বস্ত্রহরণ ইত্যাদি লীলা খেলার অবতারণা হইতেই কৃষ্ণের আর এক নাম 'ঘাঁটু' হইয়াছে। এ ব্যাখ্যার উদ্ভাবন এক উদ্ভট কল্পনা বলিয়া মনে হয়। বৈষ্ণব সাহিত্যের কোথাও(কৃষ্ণ বিষয়ক অন্যান্য গ্রন্থেও) এরূপ কল্পিত নামের সন্ধান পাওয়া যায় না। কাজেই আমরা বলিতে বাধ্য হইলাম যে শব্দটি 'ঘাটু' নহে 'গাঁটু' হওয়াই যুক্তিসঙ্গত।''
এ ব্যাপারে ড. আশরাফ সিদ্দিকী ও সিরাজুদ্দিন কাশিমপুরীর সংগৃহীত তথ্যগুলোই যুক্তিযুক্ত বলে মনত্মব্য করেন। [লোক সাহিত্য, ২য় খ-, মলিক ব্রাদার্স, ঢাকা]।
ঘাটু গানের নামকরণ নিয়ে কিছুটা বিভ্রানত্মির অবকাশ থাকলেও এর উৎপত্তি স্থান এবং কাল নিয়ে গবেষকরা মোটামুটি একমত হতে পেরেছেন। আর এতেও সিরাজুদ্দিন কাশিমপুরীর প্রামাণ্য তথ্যের সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে যথেষ্ট। কাশিমপুরী দেখিয়েছেন যে,
''ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে সিলেট জেলার আজমিরিগঞ্জের অধিবাসী উদয় আচার্য দেব গাঁটু গানের প্রবর্তক; কিন্তু উদয় আচার্য দেবের মৃতু্যর পর এই সাধন পদ্ধতি সম্পূর্ণ বিকৃত হইয়া লোকসাহিত্যে পরিণতি লাভ করিল''।
ঘাটু গানের উৎপত্তি স্থান ও কালের ব্যাপারে ড. আশরাফ সিদ্দিকীর কাছ থেকে আমরা জানতে পারি_
'....শোনা যায়, ষোড়শ শতকের প্রথমভাগে শ্রী হট্টের আজমিরিগঞ্জ নিবাসী জনৈক আচার্য রাধাভাবের নানা লীলা খেলার মধ্যে তন্ময় হয়ে থাকতেন। ক্রমে তার শিষ্য সংখ্যা বাড়তে লাগলো। নিম্নশ্রেণীর বহু বালকও তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করলো। এই ছেলেদের রাধিকা ভাব সম্পন্না উক্ত আচার্যের সখী সাজান হতো এবং তারা নীরবে নেচে রাধার বিরহের বিভিন্ন অবস্থা প্রকাশ করতো। পরবর্তীকালে বিভিন্ন বিরহ সঙ্গীতের সমবায়ে গড়ে ওঠে গাঁডু গান [লোক সাহিত্য, ২য় খ-, ১০০ পৃষ্ঠা, মলিক ব্রাদার্স, ঢাকা]।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা মোটামুটি একমত হতে পারি যে, ঘাটু গানের উৎপত্তিস্থল হচ্ছে সিলেটের আজমিরিগঞ্জ এবং এর উৎপত্তিকাল ষোড়শ শতকের প্রথমভাগ। আজমিরিগঞ্জ এলাকাটি বর্তমানে হবিগঞ্জ জেলার অধীন। সেখানকার এক গ্রামের নাম ফান্দুক। ওই গ্রামে এক সময় 'ঘাটু' কেনা-বেচা হতো। ফান্দুক গ্রামের ঘাটুদের খুব কদর ছিল বলেও জানা যায়। নেত্রকোনাসহ আশপাশের অন্যান্য এলাকার লোকজনও ওই গ্রাম থেকে ঘাটু সংগ্রহ করতেন। এছাড়া আজমিরিগঞ্জ এলাকাটির সঙ্গে নেত্রকোনার ভৌগোলিক যেমন মিল রয়েছে, তেমনি নেত্রকোনার সঙ্গে এর যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল মোটামুটি সহজ। তাই সহজেই হয়ত আজমিরিগঞ্জ থেকে শুরম্ন হওয়া ঘাটু গান নেত্রকোনা হয়ে পূর্ব ময়মনসিংহ ছড়িয়ে পড়ে।
জানা যায়, ঊনিশ শতকের শেষ পর্যনত্ম নেত্রকোনার প্রায় সব খানেই এ গানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। বিশেষ করে হাওড়াঞ্চল খালিয়াজুরি, মোহনগঞ্জ, মদন, আটপাড়া এবং কেন্দুয়া উপজেলায় এর কদর ছিল সর্বাধিক। এসব উপজেলার অনেক গ্রামেই ছিল ঘাটু গানের দল। বলা যায়, নদীনালা, হাওড়-বাঁওড়, বিলঝিল বেষ্টিত হাওড় জনপদই ছিল এ গানের শিল্পীদের মূল চারণভূমি। তবে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও বৃহত্তর সিলেট ছাড়াও ত্রিপুরার কিছু এলাকাতেও ঘাটু গানের প্রচলন ছিল বলে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে উলেস্নখ পাওয়া যায়। নেত্রকোনার জনপদে বিশ শতকের প্রথম দু'দশক পর্যনত্মও ঘাটু গান রমরমা ভাবে টিকে ছিল। এর পরবর্তী সময় থেকে তা বিলুপ্ত হতে শুরম্ন করে।
ঘাটু গানে 'ঘাটু' মূলত একটি চরিত্র। যাকে কেন্দ্র করে গানের দল এবং যিনি নটীবেশে নেচে গেয়ে দর্শকদের মাতোয়ারা করে- তাকেই বলা হয় ঘাটু। কেউ কেউ বলতেন 'ঘাটু ছোকড়া'। বালক বা কিশোর বয়সী ছেলেদের ঘাটু হিসাবে ব্যবহার করা হতো। ঘাটু ছোকড়াদের মাথায় লম্বা চুল রাখা ছিল বাধ্যতামূলক। তারা চুলে বেণী ও খোঁপা বাঁধতেন। পোশাক পরতেন সাধারণত ধুতি ও হাতকাটা গেঞ্জি। তবে গানের আসরে তারা রং-বেরং এর ঘাগড়া পরে উঠতেন। শেষদিকে তাদের শাড়ি-বস্নাউজ পরতেও দেখা যেত। ঘাটুরা মেয়েদের মতো অলঙ্কার ব্যবহার করতেন। পায়ে ঘুঙ্গুর পরতেন। তাদের চালচলনে সব সময় থাকত মেয়েলিপনার প্রকাশ। মেয়েলি স্বভাবের ছেলেরাই এতে প্রাধান্য পেত। এদের যুবতীসুলভ রূপ লাবণ্য, সুরেলা কণ্ঠ, পোশাক-পরিচ্ছদ, অঙ্গভঙ্গি ও নৃত্যই ছিল দর্শকদের মূল আকর্ষণ।
আগেই বলা হয়েছে, অন্যান্য এলাকার মতো নেত্রকোনায়ও টাকার বিনিময়ে ঘাটুদের কেনা-বেচার প্রচলন ছিল। এমনকি জমি-জমার মতো বন্ধক বা পত্তন দেয়ার প্রথাও চালু ছিল। এ জন্য নাচে-গানে ভাল এবং সুন্দর ঘাটুদের নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হতো। এ নিয়ে মারামারির উদ্ভব হয়েছে কখনও কখনও। হয়েছে বিচার-সালিশও। ঘাটু ছোকড়াকে যারা কিনতেন বা পুষতেন- তাদের বলা হতো 'সখিনদার' বা 'ঘাটু সর্দার'। সখিনদাররাই ছিলেন ঘাটুদের মূল কর্তা বা অভিভাবক। কিংবদনত্মি আছে, 'বউ পালা আর ঘাটু পালা একই কথা'। অর্থাৎ নিজের বিবাহিত স্ত্রীকে যেমন আদর-সোহাগ বা ভরণ-পোষণ করা হয়, ঘাটু ছোকড়াদের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটত না। ঘাটু লালন-পালন করা তখনকার সমাজ জীবনে ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। ঘাটুগানের দলের নিয়ন্ত্রণ করতেন সখিনদাররা। তবে দল পরিচালনার জন্য থাকতেন একজন 'সরকার' বা 'মরাদার' (মহড়াদার>মরাদার)। মরাদার বা সরকাররা তিলে তিলে সযত্নে আনকোড়া ঘাটুকে নাচ-গান শিখিয়ে পাকাপোক্ত শিল্পীতে পরিণত করতেন। এছাড়া নেত্রকোনার প্রায় গ্রামেই ছিল দু-একজন সমঝদার। তারা ঘাটু দলের সঙ্গে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এদিকে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য ঘাটুদেরও কঠোর সাধনা করতে হতো। তাদের আয়ত্ত করতে হতো তত্ত্বকথা এবং নৃত্য কলা। ধ্রম্নপদী নৃত্যকলার নিয়মকানুন কিছুই অনুসরণ না করলেও তাদের নৃত্যানুষ্ঠান এতই সূক্ষ্ম ও রম্নচিশীল ছিল যে, তা দর্শক-শ্রোতাদের মনে কার্যকরভাবে প্রেমের বিরহ-বেদনা জাগিয়ে তুলতে পারত। ঘাটু গানের দলে আরও ক'জন সদস্য থাকত। এদের বলা হতো যন্ত্রী, দোহার বা পাইলদার। এদের কাজ ছিল যন্ত্র বাজানো এবং ঘাটুর সমস্বরে গান গাওয়া বা দোহার(পাইল) ধরা। দোহার বা পাইলরা যখন গান গেয়ে যেতেন ঘাটু তখন নাচ ও অঙ্গ-ভঙ্গিমায় মাতিয়ে তুলতেন মঞ্চ। এ গানে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হতো ঢোল, খোল, বেহালা, সারিন্দা, মন্দিরা, বাঁশি, করতাল, হারমোনিয়াম, দোতারা ইত্যাদি। তবে বাঁশির ব্যবহার ছিল অত্যাবশ্যকীয়।
যতদূর জানা যায়, ঘাটু গানের দু'টি ধারা ছিল। একটি ছিল প্রতিযোগিতামূলক। অন্যটির নাম 'ছম গান'। প্রতিযোগিতামূলক গানে তত্ত্বজ্ঞান সম্পন্ন সমঝদারদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। তারা প্রতিযোগিতার রায় দিতেন। প্রতিযোগিতামূলক ঘাটু গানও ছিল দু'ধরনের। যেমন : 'প্রকাশ্য ঘাটু গান' ও 'চাপা ঘাটু গান'। প্রকাশ্য ঘাটু গান ছিল জমজমাট এবং সহজ বোধ্য। চাপা গান ছিল কিছুটা কঠিন। সমঝদাররাই এর নিগূঢ় তত্ত্ব বুঝতেন। কারণ, চাপা গানে অনেকটা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মতো শুধু সুর বা রাগিণী উচ্চারণ করা হতো। শব্দ বলা হতো না। প্রতিযোগিতামূলক গানে এক দল গীত-গানের মাধ্যমে অন্য দলকে প্রশ্ন করত। বিপক্ষ দল তার উত্তর দিত। অথবা একদলের গাওয়া গান অন্য দলকে ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণ করতে হতো। এ জাতীয় গানে এক পক্ষ রাধা হলে অপর পক্ষ হতো কৃষ্ণ। গানের কাহিনী বিন্যাসের প্রয়োজনে ঘাটুরাই গানের মাঝে সখা-সখির ভূমিকায় রূপানত্মরিত হতেন। তাৎক্ষণিক অঙ্গভঙ্গি পরিবর্তন করে রীতিমতো পুরম্নষ চরিত্র ধারণ করতেন তারা। প্রতিযোগিতামূলক ঘাটু গানের কয়েকটি চরণ:
রাধার প্রেরিত সখা এসে সুবলকে জানাচ্ছে-
দুঃখে-কষ্টে আছেরে শ্যাম তোমার বিধূমুখী
দশম দশায় পড়িয়াছে মরণ কেবল বাকি
আমারে পাঠাইয়া দিল, যাবে কি না যাবে বল
উন্মাদিনী হইয়া গেল সত্য যুগের লক্ষ্মী্ত-
এরপর প্রতিপক্ষের ঘাটু কৃষ্ণ রূপে এসে উত্তর দেয় :
আমি যাইতেও পারি না, মনেও তো মানে না
যাব না সুবল আমি রাধার খবরে
দেখ সুবল তুমি চিনত্মা করে
আমি তার প্রেমে পোড়া, পুড়লাম জনম ভরা
দেখাই প্রেমের ইশারা, রেখ স্মরণ কর্ত্তে-
'ছম গান' অনেকটা বৈঠকী ধারার গান। শোনা যায়, এই ধারাটিই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। ছম জাতীয় ঘাটু গানও বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। যেমন : ''....'জলভরা', 'বিচ্ছেদ', 'রং-বাউলা', 'মূরলী' ইত্যাদি। রং-বাউলা গানের সঙ্গে বাউল গানের ঘনিষ্টতা অতিশয় নিবিড়; বাউলের দেহতত্ত্বমূলক গানের সঙ্গে 'ছম রংবাউলা' গানের মিল লক্ষ্য করা যায়''। [ময়মনসিংহের লোকগীতি ও লোক সংগীত, মোহাম্মদ আজিজুল হক চৌধুরী, ময়মনসিংহের সাহিত্য ও সংস্কৃতি, জেলা বোর্ড, ময়মনসিংহ, ১৯৭৮]
ঘাটু গানের মূল বিষয়বস্তু ছিল রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলা। চিরায়ত এ প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করেই রচিত হতো ঘাটু দলের গান। আসরে উঠে ঘাটু প্রথমে বন্দনা গাইতেন। এরপর প্রেম, প্রেমতত্ত্ব, মান, অভিমান, বিচ্ছেদ, মিলন, সন্ন্যাস প্রভৃতি বিষয় অবলম্বন করে প্রবাহিত হতো তার গীতধারা। শ্রী কৃষ্ণের মথুরা গমনের পর অথবা তার সানি্নধ্য না পেয়ে রাধার বিরহ উপলক্ষ করে রচিত বিচ্ছেদ গানগুলোতে পরিলক্ষিত হতো চিরনত্মন বেদনার সুর। অনেকের মতে, ছম ঘাটু গানের রাধা-কৃষ্ণের বিরহ সঙ্গীত থেকেই নেত্রকোনার অন্যান্য লোক সংগীতে 'রাই ধারা' ও 'শ্যাম ধারা'র উদ্ভব।
ছম জাতীয় মূরলী শ্রেণীভুক্ত একটি ঘাটু গান :
আমার মনের বেদন
সে বিনে কেউ জানে না
কালা যখন বাঁজায় বাঁশি
তখন আমি রান্তে বসি
বাঁশির সুরে মন উদাসী
ঘরে থাকতে পারি না
আমার মনের ........।
আবার রসাত্মক বা ব্যঙ্গাত্মক কিছু গানও পরিবেশন করা হতো ঘাটু গানে। যেমন :
রাধার বস্ত্র, কানুর বাঁশি থইয়া নামলো জলে
বাঁশি নিল চিকন কালা, বস্ত্র নিল স্রোতে
জল ভর যৌবতি কন্যা জলে দিছ মন
কালাচান আসিয়া বস্ত্র করিল হরণ
জল ভরা ছম গানগুলোতে ছিল হাওড়-নদী-নালাসহ প্রকৃতির বর্ণনার পাশাপাশি প্রেম-বিরহের ইঙ্গিত। জলভরার একটি গান :
ভরা নদীর বাঁকে বাঁকে
ভাইটাল নদীর ফাঁকে ফাঁকে
দেখা যায় তার ঘর খানি লো
সেথায় বন্ধু থাকে গো
আমার বন্ধু থাকে গো
দুপুর বেলায় বটের ছায়ায়
উদাস করে শরীর মায়ায়
মন চলে যায় বন্ধুর দেশে
দেখব বলে তারে গো
দেহতত্ত্বমূলক ছম গান:
কোন্ কামেলায় বানছে ঘর
ধন্যরে তোর সাধের কারিগর
নব কোঠায় ঘর বাইন্দ্যাছে
কোঠায় কোঠায় মানুষ আছে
উপর তলায় জ্বলছে বাতি
নীচের তলায় জুম্মা ঘর
হিন্দু ধর্মের রাধাঁ-কৃষ্ণ কাহিনীই ঘাটু গানের মূল প্রতিপাদ্য হলেও এক পর্যায়ে ইসলাম ধর্মের নানা বিষয়সহ নর-নারীর সাধারণ প্রেম-বিরহ এবং সমসাময়িক বিষয়বস্তুও উঠে আসে ঘাটু গানে। কারণ, হিন্দু-মুসলিম উভয় সমপ্রদায়ের লোকজনই ছিল ঘাটু গানের দর্শক-স্রোতা। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোন ধর্মীয় সীমা-পরিসীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ঘাটু গান হিন্দু-মুসলিম উভয় সমপ্রদায়ের একটি সাধারণ লোকসঙ্গীত হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছিল। সমাজের লৌকিক চেতনার মধ্য দিয়েই হয়েছিল এর বিকাশ। তবে এটিও সত্য, এক সময় নিম্নশ্রেণীভুুক্ত হিন্দু সমাজের লোকজনই ছিল এর প্রধান বাহক।
ঘাটু গান পরিবেশনের জন্য নির্দিষ্ট কোন সময় ধরা-বাধা ছিল না। বছরের প্রায় সব সময়ই ঘাটু গান হতো। তবে ভৌগোলিক কারণে বর্ষাকাল(জ্যৈষ্ঠের শেষ থেকে ভাদ্রের শেষ পর্যনত্ম) ছিল ঘাটু গানের উৎকৃষ্ট সময়। এছাড়া হিন্দু সমপ্রদায়ের রথযাত্রা উৎসব বা অষ্টমী স্নান উপলক্ষেও অনেক স্থানে ঘাটু গানের আয়োজনের রেওয়াজ ছিল। পৃষ্ঠপোষকতার কোন অভাব ছিল না। জমিদার-সামনত্ম প্রভুরা ছাড়াও গ্রামের সাধারণ মানুষজনও বাড়ি বাড়ি চাঁদা তুলে ঘাটু দলকে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ঘাটু গানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে স্থানীয় লোক সাহিত্য সংগ্রাহক সনত্মোষ সরকার দাবি করেন_ 'এককালে উচ্চ বর্ণের হিন্দু, মুসলমান রাজা-জমিদারগণ তাদের মনোরঞ্জনের জন্য বাঈজীদের নাচ-গান শুনতেন এং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বাঈজীদের এই নাচ-গান উপভোগের সুযোগ ছিল না সাধারণ দর্শকদের। তাই বালক বয়সের ছোকড়াদের মেয়ে সাজিয়ে ঘাটু গানের প্রচলন শুরম্ন হয় এবং এর সুর মাধুর্য্য, নৃত্যকলা, রূপ-রসবোধ ও সব শ্রেণীর লোকদের অংশগ্রহণের সুযোগের কারণে সহজেই তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে'। [নেত্রকোনার লোকজ সংস্কৃতির ঐহিত্য ঘাটু গান, নেত্রকোনার লোক জগত, সম্পাদক- স্বপন পাল, প্রকাশক- স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতি, ২০০২]।
নিরক্ষর-সাধারণ লোকদের মনোরঞ্জনের জন্য ঘাটু গানে আকারে-ইঙ্গিতে কিছু স্থুল শব্দ বা বাক্য ব্যবহারের প্রচলন ছিল। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার যে, বিশ শতকে এসে তা রীতিমতো অশস্নীলতা ও কুরম্নচিপূর্ণ হয়ে ওঠে। নটীবেশী 'ঘাটু' চরিত্রটিকে ঘিরে সমাজে নানা অসামাজিক কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়ে। সম্পূর্ণ স্থুল রসাত্মক এবং অশস্নীল গান পরিবেশনের হিড়িক ওঠে। এ ধরনের একটি স্থুল রসাত্মক কিন্তু বহুল জনপ্রিয় গান :
কে দিল পিরিতের বেড়া, লেচুর বাগানে।
লেচুর বাগানে নারে কমলার বাগানে।
ছোট ছোট লেচুগুলি, বন্ধে তুলে আম্ব(আমিও) তুলি
বন্ধে দেয় আমার মুখে, আমি দেই বন্ধের মুখে।
কে দিল.............।
নিন্দিত কার্যকলাপ, অশস্নীল নতৃ্য-গীতের কারণে ঘাটু গান শেষ সময়ে এসে অনেকের কাছে 'অপ সংস্কৃতি' বলে বিবেচিত হয়। ফলে ভদ্র সমাজ ক্রমান্বয়ে ঘাটুগানের আসর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এছাড়া অর্থনৈতিক বহুবিধ দৈন্যতা এবং সামাজিক অস্থিরতার কারণে পৃষ্ঠপোষকতাও কমে যায়। ঘাটু বা গাডু শব্দটি এক পর্যায়ে নেত্রকোনার একটি লৌকিক 'গালি'তে পরিণত হয়। ওঠতি বয়সের বখাটে ছেলেদের বিদ্রূপ করতে গিয়ে এখনও অনেকে 'গাডু' বা 'ঘাটু' বলেন। আর এসব বহুবিধ কারণেই ঘাটুগানের বিলুপ্তি অনিবার্য হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে একটি উদ্ধৃতি-
''ঘাটু গান বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। অর্থনৈতিক দৈন্যজনিত অস্থিরতায় সদা চিনত্মাক্লিষ্ট মন এরূপ আনন্দ রসে টইটুম্বুর ঘাটু গানের প্রতি মনযোগী হওয়ার জন্য সম্পূর্ণরূপে অসমর্থ। এই একই করণে মহড়াদার বা সরকারগণকে যেসব শাস্ত্রজ্ঞান মন্থন করে ঘাটুগানের তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহ করতে হতো, তাও সম্ভব নয়। এদিকে আবার ঘাটুর অসত্মিত্ব রয়েই গেল এবং 'শৌখিন' যুব সমাজের কাছে তাদের আদর-কদরও কমলো না। কমলো তো না-ই বরং 'একটি চাহিদা' পূরণের অবলম্বনরূপে ঘাটুর প্রতি তাদের অনুরাগ এবং আসক্তি অনেক বেড়ে গেল। ....এরূপ অবস্থায় গ্রামে সহিংস কলহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং সমাজে প্রকৃত রহস্যও উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ল। সামাজিক আবহাওয়াকে সুস্থ ও সন্দুর রাখার উদ্দেশ্যেই শেষ পর্যনত্ম ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী লোক সংগীত ঘাটু গানের অবসান ঘটল''। [ময়মনসিংহের লোকগীতি ও লোক সংগীত- মোহাম্মদ আজিজুল হক চৌধুরী, ময়মনসিংহের সাহিত্য ও সংস্কৃতি, জেলা বোর্ড, ময়মনসিংহ, ১৯৭৮]
বিশ শতকের প্রায় শেষ দিকে ঘাটু গান সম্পর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। এ সময় কেন্দুয়ার লোক ঐতিহ্য সংগ্রাহক সন্তোষ সরকার কিছুটা হাল ধরেছিলেন ঘাটুগান রক্ষায়। আরও ক'জন স্থানীয় উদ্যোক্তার সহযোগিতায় তিনি নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছিলেন 'ঝংকার শিল্পী গোষ্ঠী' নামে একটি সাংস্কৃতিক দল। এ দলটি নেত্রকোনার পৌষমেলা, বৈশাখী মেলাসহ ঢকার কিছু অনুষ্ঠানে ঘাটু গানের একটি চিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করে। কিন্তু তা-ও বেশিদূর এগোয়নি। নানা প্রতিবন্ধকতায় সেই 'ঝংকার'ও থেমে গেছে এক সময়। এরপর আর কেউ ঘাটু গান রক্ষায়ও এগিয়ে আসেননি। এদিকে সিরাজুদ্দিন কাশিমপুরীর পরবর্তীকালে এ অঞ্চলের ঘাটু গান নিয়ে বড় কোন গবেষণা বা অনুসন্ধানও হয়নি। এসব কারণে লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে গেছে ঘাটু গানের অনেক গীত ও এর এর ধারক-বাহকরা। আর দু-এক দশক গেলে পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো 'ঘাটু' শব্দটিই আর শুনবে না কোনদিন।
আরও পড়ুন: ঠাকুরগাঁওয়ে জজশীপ ও ম্যাজিস্ট্রেসী আদালতের প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ