সরস্বতী পূজা ও ভালোবাসা
স্কন্ধ পুরান অনুযায়ী দেবী সরস্বতী এক নদী। পুরাকালে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মধ্যে এক ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছিল। এর থেকে ভাদবগ্নি নামক একটি সর্বগ্রাসী আগুনের জন্ম হয়। সমগ্র সৃষ্টি ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছিল। তখন দেবী সরস্বতী ব্রহ্ম লোক ত্যাগ করে ঋষি উত্তঙ্কের আশ্রমে আসেন। ভগবান শিবের অনুরোধে সরস্বতী নদী নাম ধরে সমুদ্রের দিকে ধাবিত হন। সৃষ্টি ভাবদগ্নির থেকে রক্ষা পায়।
জ্ঞানের দেবীকে এখন নদীরূপে পূজা করা হয় না। কারণ ঐ নদী ময়লা আবর্জনার ভাগাঢ় হয়ে পড়েছে। দেবীর মূর্তি হয় উর্বশীর আদলে। ভাবা যায় ? যায়। আজ আমরা অন্ধ। জীবনানন্দের ভাষায় অন্ধরাই বেশি দেখছে আজ। ইদানিং যারা সরস্বতী পূজা করছেন তাদের মধ্যে জ্ঞান, বিদ্যা সঙ্গীতের কদর খুব কম। পূজার আয়োজনে এদের যত আগ্রহ পূজার মাহাত্ম্য জ্ঞান লাভে এদের তত আগ্রহ নেই। আছে দেবীর আরাধনায় ভালোবাসার বিরাট অভাব।
দেবীর পূজার অজুহাতে চাঁদা আদায়ে বিভিন্ন শ্রেণীর লোক তৎপর। আর এ কাজে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগায় এক শ্রেণীর লোক। তাই বিদ্যার দেবীকে নিয়ে এসব ধানাই পানাই করার পূর্বে দুষ্ট বুদ্ধির লোকের সরস্বতী দেবী সম্পর্কে জানা উচিত। এই দেবী বাগদেবী। সরস্বতীর জানা আছে আটষট্টি কলা। আমরা পাড়ায় মহল্লায় অনেক চতুর লোক পাই যারা নিজেদের সরস্বতীর বাহন ভাবে। তারা জানে সরস্বতীর বাহন হংস জলে স্থলে অন্তরীক্ষে বিচরণ করতে পারে। জল আর দুধের মিশ্রণ থেকে জল দুধ আলাদা করতে পারে। বিদ্যার দেবী সরস্বতী রামায়ণে পূজিত হয়েছেন।
নতুন করে যারা বিদ্যার দেবীকে পূজার একমাত্র এজেন্ট ভাবছেন তাদেরকে বেদ পুরান রামায়ণ পড়ে এসব জানতে হবে। এসকল জ্ঞান অর্জন করলে কোন হিন্দু পূজা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে পারে না। দেবীর মাহাত্ম্য জানলে নিজের মাহাত্ম্যের প্রচারে দাদাগিরি করে না। বাগদেবীর বরে শিক্ষিত ব্যক্তি দেবীর সামনে ছলা কলা দেখান না। কারণ তিনি জানেন সরস্বতীর পূজায় পুস্তক আর বীণার আরাধনা হয়। এখানে পূজারীকেও জ্ঞানী হতে হয়। পুস্তক বিবর্জিত লোকের দেবীর আরাধনায় ফল লাভ হবার কথা নয়। অথচ আমরা দেখি বইয়ের চেয়ে বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত লোকজন সরস্বতীর পূজায় পাড়া গরম করছে। কারণ ছোট্ট পরিসরের পূজায় নেতৃত্ব দান। এটা পাগলামী ছাড়া আর কী হতে পারে?
ঘরে ঘরে সরস্বতী পূজা। কারো ঘরে বিদ্যা নেই। কেউ বাজার থেকে একখানা বই কিনে আনে না। পাড়াভর্তি লোক সদাই কিনে বাসায় ফেরে। কত জনের হাতে বড় মাছ, খাসির মুণ্ডু, ব্রান্ডের পোষাক। বই দেখি না। আবার এসব লোকেরাই সরস্বতী পূজা ছাড়া বুঝে না। যে পুরোহিত মন্ত্র পড়ান, বিদ্যা মহাভাগে। আশি ভাগ পুরোহিত বিদ্যার মহাভাগের কতটা জানেন বুঝেন সরস্বতীই ভালো জানেন! সরস্বতী পূজা শুধুই হিন্দুরা করেন তা না। শিখ জৈন এবং আরো অনেক সম্প্রদায়ের লোক পূজা করে থাকে। বাংলাদেশ ,ভারত ,পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশেই সরস্বতীর পূজা হয়। ইন্দোনেশিয়ায় রয়েছে সরস্বতীর সবচেয়ে বড় মূর্তি।
বাংলাদেশে যারা সরস্বতীর পূজা করেন তাদের আমরা কয়েক শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি। ভাগ করাটা জরুরী। নইলে বিদ্যার দেবী জ্ঞানের দেবী অজ্ঞানীদের দখলে চলে যাবেন। এখনই এদের মুখোশ খোলে না দিলে মাত্র পঞ্চাশ বছর পরে সরস্বতী পূজার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হবে। কারণ পূজারীর মুখোশে যারা পূজায় অংশগ্রহণ করে সবাই একই উদ্দেশ্য নিয়ে আসে না।
পূজা মানে আধিপত্য বিস্তার। পূজা এলেই একদল লোক সভাপতি, সম্পাদক পদ দখল করে নিজেকে জাহির করতে চায়। বড় প্ল্যাটফর্ম দখল না করতে পেরে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাতে চায়। ফলে বাড়তে থাকে মণ্ডপ। একদল ছ্যাচড়া লোক আছে। যেখানেই সুযোগ পায় একটু দাও মারতে চায়।একটা গামছা, একটা লোটা নিদেনপক্ষে একটা নারিকেল। তাই পূজার আয়োজনে এদের জ্বিব লকলক করে। নিজের গাঁট থেকে এরা এক পয়সাও খরছ করবে না। কিন্ত পারলে অন্যের কাছ থেকে চাঁদা কেড়ে নিয়ে আসবে।নিজে কোন কাজ করবে না কিন্ত ভাবখানা এমন দেখাবে যে পূজা না করলে হিন্দুয়ানা যায় যায়।
তৃতীয় শ্রেণির লোকেরা পূজা করলেও আছি না করতে পারলেও সমস্যা নাই। পূজা এদের কাছে জীবন মরণের সমস্যা না। পূজা এদের কাছে ধর্মীয় উৎসব। সামর্থ্য অনুযায়ী অংশগ্রহণ করতে চায়। কিন্ত উপরোল্লিখিত দুই শ্রেণির লোকের জন্য তৃতীয় শ্রেণির লোকেরা বেশ কষ্ট পান। না পারেন সইতে না পারেন কইতে।
চতুর্থ শ্রেণির লোকেরা সংখ্যায় কম হলেও এরাই সরস্বতীর প্রকৃত পূজারী। এরা নিজেদের ঘরে বা মন্দিরে একান্ত নিজের করে দেবীর আরাধনা করতে চান। এরা কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করেন সরস্বতীর কৃপা না হলে পড়াশুনা করেও লাভ হবে না। বিদ্যালাভ দেবীর পূজা ছাড়া অসম্ভব। ভাবগাম্ভীর্য হারানোর ফলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরস্বতী পূজা বন্ধ করে দিয়েছে অপসংস্কৃতির অজুহাতে। ছোট বেলায় দেখেছি যেসব স্কুলে পূজা হয়েছে তার অনেকটাই বন্ধ, অনেকগুলো চলছে জোড়াতালি দিয়ে। এর জন্য প্রধান দায়ী সমাজের সেসব সুচতুর লোক যারা পূজার নামে নিজেদের আখের গোছাতে চায়। অবস্থা চিরকাল এরকমই ছিল। তবে বর্তমান সময়কে সকলেই দায়ী করে। অতীতকে স্বর্ণযুগ হিসেবে আমরা দেখি। যায় দিন ভালো,আসে দিন খারাপ।
প্রত্যেক পূজার পৃথক উদ্দেশ্য রয়েছে। মূখ্য গৌণ লাভালাভের হিসাব রয়েছে। সরস্বতী পূজার মূখ্য উদ্দেশ্য জ্ঞান লাভ। সরস্বতী বৈদিকসূত্রে বিদ্যার দেবী। বাঙালির বোধক্রমে এরূপ হয়েছে বিদ্যা মানে পাঠ্যপুস্তক। তাই ছাত্রছাত্রীদের এই পূজার দায়। ছাত্র জীবন শেষে বাঙালির বিদ্যার আর কি দরকার ?
সমাজের মগডালে ওঠার জন্য বিদ্যার চেয়ে অবিদ্যার প্রয়োজন বেশি। বিদ্যা কী ? ছাত্রছাত্রীরা দেবীর চরণে পাঠ্যপুস্তক সঁপে দিয়ে কী বর চায়?
ভালো রেজাল্টের নাম বিদ্যা।
বিদ্যা প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞান, শিক্ষা, দর্শন বা কোনো বাস্তব জ্ঞানের ক্ষেত্রে "সঠিক জ্ঞান" বোঝায় যা বিতর্কিত বা খণ্ডন করা যায় না। এর মূল হল বিদ সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ হল "বিবেচনা করা", জ্ঞাতা, সন্ধান করা, জানা, অর্জন করা বা বোঝা। অর্থ্যাৎ কী করে কাজ করতে হবে জানতে পারাই বিদ্যা। বিদ্যা ভালো মন্দ দুটোই হতে পারে। চুরি বিদ্যাও বিদ্যা। বিশাল বিদ্বান হয়ে মানুষ যখন পুকুর চুরি করে তখন সরস্বতীর ওপর দোষ চাপানো যায় ?
সরস্বতীর পূজা করা শিক্ষক যখন ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তখন তার বিদ্যা লোপ পায়, অবিদ্যা তাকে পেয়ে বসে। কিন্ত প্রশ্ন হলো যে সব ব্যক্তির চুরি ধর্ষণ প্রকাশিত হয় না, আড়ালে থাকে সরস্বতী তাদের বিদ্যা কেড়ে নেন না কেন? মহাভারতের কর্ণ যেভাবে প্রয়োজনের সময় অস্ত্র আহ্বান মন্ত্র ভুলে গিয়েছিলেন। না সরস্বতীর এরকম এ্যাকশনের কথা আমরা শুনতে পাই না। যদি এরকম ব্যবস্থা থাকত অনেকেই এই কঠিন ব্রতে আগ্রহী হতেন না। আমরা একবার বিদ্বান হয়ে গেলে চিরকালের বিদ্বান। সামান্যতম ঘষামাজা ছাড়াই বিদ্বানের সার্টিফিকেট অমলিন থাকে। সরস্বতীর কোমলতাই আমাদের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের দুর্গতির কারণ। অনেকে বলবেন বিদ্যার প্রয়োগকে বলা হয় শিক্ষা। তাই এসব অপকর্মে বিদ্যার কোন দোষ নেই। বিদ্যার দেবীরও কোন দায় নেই। বিদ্যা নিষ্পাপ।
এবারের সরস্বতী পূজা ভালোবাসা দিবসে। এমনিতেই সরস্বতী পূজাকে বলা হয় হিন্দু শিক্ষার্থীদের ভ্যালেন্টাইন ডে। তাই এবছর সোনায় সোহাগা। পূজা আর ভালোবাসা মিলে একাকার। কূপমন্ডুকতাকে দূরে ঠেলে ভালোবাসাকে যারা পূজা জ্ঞান করেন কবে তারা এগিয়ে আসবেন এটা একটা বিশাল প্রশ্ন।
প্রাবন্ধিক